হিমালয়ে গরম না পড়ে বরফ পড়ার বৈজ্ঞানিক কারণ
Google Ads
হিমালয়ে গরম না পড়ে বরফ পড়ার বৈজ্ঞানিক কারণ
হিমালয় পর্বতমালা পৃথিবীর সর্বোচ্চ এবং অন্যতম রহস্যময় পর্বতমালা। এটি শুধুমাত্র তার সৌন্দর্যের জন্য নয়, বরং তার চরম আবহাওয়া এবং বরফঢাকা শৃঙ্গগুলোর জন্যও বিখ্যাত। অনেকেই প্রশ্ন করেন, কেন হিমালয়ে গরম পড়ে না? কেন সেখানে সারা বছর বরফ জমে থাকে? এই প্রশ্নের উত্তর বোঝার জন্য আমাদের কিছু বৈজ্ঞানিক ও ভৌগোলিক বিষয় বিশ্লেষণ করতে হবে।
---
হিমালয়ের ভৌগোলিক পরিচিতি
হিমালয় পর্বতমালা এশিয়ার দক্ষিণে অবস্থিত এবং এটি ভারত, নেপাল, ভুটান, পাকিস্তান ও তিব্বতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের ওপর প্রসারিত। এই পর্বতমালার সবচেয়ে উঁচু শৃঙ্গ হলো এভারেস্ট, যার উচ্চতা ৮,৮৪৮ মিটার (২৯,০৩১.৭ ফুট)।
উচ্চতার জন্য হিমালয়ের আবহাওয়া পৃথিবীর সমতল অঞ্চলের তুলনায় একেবারে আলাদা। এখানে গ্রীষ্মকালেও বরফ পড়ে এবং তাপমাত্রা প্রায় সর্বদা হিমাঙ্কের নিচে থাকে।
---
হিমালয়ে গরম না পড়ে বরফ পড়ার প্রধান কারণ
১. উচ্চতা এবং তাপমাত্রার পরিবর্তন
আমরা জানি, উচ্চতার সাথে সাথে তাপমাত্রা কমতে থাকে। সাধারণভাবে, প্রতি ১,০০০ মিটার উচ্চতায় তাপমাত্রা প্রায় ৬.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমে যায়। সমুদ্রপৃষ্ঠে যেখানে গড় তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস হতে পারে, সেখানে ৫,০০০ মিটার উচ্চতায় তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে নেমে যায়।
যেহেতু হিমালয়ের শৃঙ্গগুলো অনেক উঁচু, তাই সেখানে বাতাস এতটাই ঠান্ডা যে বরফ গলতে পারে না এবং বছরের অধিকাংশ সময় নতুন বরফ পড়তে থাকে।
---
২. বায়ুর চাপ এবং আর্দ্রতার প্রভাব
উচ্চতার সাথে সাথে বায়ুর চাপ কমে যায়। ফলে, হিমালয়ের ওপরের অংশে বাতাস অনেক হালকা ও ঠান্ডা থাকে।
যখন আর্দ্র বাতাস সমতল অঞ্চল থেকে উঠে আসে, তখন এটি ঠান্ডা হয়ে যায় এবং জলীয় বাষ্প বরফে পরিণত হয়।
উচ্চতার কারণে হিমালয়ের অঞ্চলে তাপমাত্রা কম থাকে, তাই বর্ষার সময় বৃষ্টির বদলে বরফ পড়ে।
---
৩. সূর্যালোকের প্রতিফলন (Albedo Effect)
বরফের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এটি সূর্যের আলো প্রতিফলিত করে।
সমতলে যেখানে গরম পড়ে, সেখানে মাটি সূর্যের তাপ শোষণ করে।
কিন্তু হিমালয়ের বরফ ঢাকা শৃঙ্গ সূর্যের তাপ শোষণ করার পরিবর্তে প্রতিফলিত করে, ফলে তাপমাত্রা কম থাকে এবং নতুন বরফ জমতে থাকে।
এই প্রভাবের কারণে হিমালয়ের আবহাওয়া স্বাভাবিকভাবেই ঠান্ডা থাকে এবং গরম পড়ার সম্ভাবনা কমে যায়।
---
৪. মৌসুমি বায়ু এবং তুষারপাত
হিমালয়ে গরম না পড়ার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ মৌসুমি বায়ু এবং পশ্চিমী ঝড় (Western Disturbances)।
শীতকালে, পশ্চিমী ঝড় প্রচুর ঠান্ডা বাতাস ও বরফ নিয়ে আসে, যার ফলে হিমালয়ের তাপমাত্রা আরো কমে যায়।
গ্রীষ্মকালে, ভারত মহাসাগর থেকে আগত মৌসুমি বায়ু হিমালয়ে আঘাত করে এবং এর আর্দ্রতা বরফে পরিণত হয়। ফলে, গরমের বদলে বরফ পড়ে।
---
৫. তাপমাত্রার চক্র এবং গ্লেসিয়ার তৈরি হওয়া
হিমালয়ে যেহেতু বছরের অধিকাংশ সময় তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে থাকে, তাই এখানে প্রচুর গ্লেসিয়ার (হিমবাহ) তৈরি হয়।
এই গ্লেসিয়ারগুলো বছরের পর বছর ধরে বরফ জমিয়ে রাখে।
বরফ গলতে শুরু করলেও নতুন বরফ পড়ে যায়, ফলে হিমালয় সবসময় বরফাচ্ছন্ন থাকে।
---
৬. বায়ুমণ্ডলের স্তর এবং ওজোনের প্রভাব
পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে বিভিন্ন স্তর আছে, যেমন ট্রপোস্ফিয়ার, স্ট্রাটোস্ফিয়ার, ইত্যাদি।
হিমালয়ের শীর্ষ অংশ ট্রপোস্ফিয়ারের উপরের দিকে অবস্থিত, যেখানে তাপমাত্রা খুব কম থাকে।
এ অঞ্চলে ওজোন স্তরের উপস্থিতি কম থাকে, ফলে সূর্যের তাপ সহজে শোষিত হয় না এবং গরম পড়ার পরিবর্তে শীতলতা বজায় থাকে।
---
হিমালয়ের আবহাওয়া এবং জলবায়ু পরিবর্তন
বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে হিমালয়ের বরফ কিছুটা গলছে।
বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে হিমালয়ের গ্লেসিয়ার দ্রুত গলছে।
যদিও এখানকার উচ্চতা ও প্রতিফলন ক্ষমতার কারণে বরফ পুরোপুরি গলে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই, তবে গ্লোবাল ওয়ার্মিং হিমালয়ের জলবায়ুর ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।
তবে, এখনো পর্যন্ত হিমালয়ে গরম না পড়ে বরফই বেশি পড়ে এবং এটি ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে, যদি না তাপমাত্রা খুব বেশি বেড়ে যায়।
---
উপসংহার
হিমালয়ে গরম না পড়ে বরফ পড়ার পেছনে বেশ কিছু বৈজ্ঞানিক ও প্রাকৃতিক কারণ আছে।
1. উচ্চতার কারণে তাপমাত্রা স্বাভাবিকভাবেই কম থাকে।
2. বাতাসের নিম্নচাপ ও আর্দ্রতার কারণে বরফ বেশি জমে।
3. সূর্যালোকের প্রতিফলন বরফ গলতে দেয় না।
4. মৌসুমি বায়ু ও পশ্চিমী ঝড় প্রচুর তুষারপাত ঘটায়।
5. গ্লেসিয়ার ও বায়ুমণ্ডলের স্তর বরফ ধরে রাখতে সহায়তা করে।
এই কারণগুলোর জন্য হিমালয় বরফে ঢাকা থাকে এবং এখানে গরম পড়ার বদলে বরফ পড়তে থাকে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কিছু প্রভাব পড়লেও, এখনো পর্যন্ত হিমালয় পৃথিবীর অন্যতম শীতল অঞ্চল হিসেবে টিকে আছে।
Google Ads
Google Ads
Google Ads
Google Ads
Newer Posts
Newer Posts
Older Posts
Older Posts
Comments